adv
২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছিনতাইকারী ছাত্রলীগ ও একটি স্বপ্নের মৃত্যু

image_64776_0ঢাকা: কলেজের লেখাপড়া শেষ হয়েছিল আসাদুজ্জামান আল ফারুকের। চাকরির পরীক্ষা দিতে ১০ দিন আগে ঢাকায় আসেন তিনি। স্বপ্ন ছিল চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবেন, সবার মুখে হাসি ফোটাবেন। এ স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আনকোরা স্বপ্নটির অকাল ও মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটলো।

আধিপত্য বিস্তারের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার রাতে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে প্রাণ হারান ফারুক। জানা গেছে, কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লব গ্রুপের নেতা জুয়েল খানের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হাসান সুইম গ্রুপের সংঘর্ষের সময় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। নিহত ফারুক কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন।

সুইম গ্রুপ ফারুককে তাদের গ্রুপের কর্মী বলে দাবি করলেও স্বজনরা বলছেন, ফারুক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। গোলাগুলির মাঝে পড়ে তিনি নিহত হন।

এ ঘটনায় গতকাল শনিবার নিউমার্কেট থানায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ থেকে ১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন কলেজ ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সুইম। তবে পুলিশ এখনো পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীকেই গ্রেপ্তার করেনি।

এদিকে সংঘর্ষ ও প্রাণহাণীর ঘটনায় সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকসহ আট জনকে বহিষ্কার এবং কলেজ কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ জানান, গতকালই (শুক্রবার) তিনি ও সম্পাদক স্বাক্ষর করে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন।

অধিপত্যের বিরোধেই সংঘাত

গত শুক্রবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হন ওই হলের দ্বিতীয় তলার ২০৯ নম্বর কক্ষের ছাত্র ফারুক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর রাত ১টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই ঘটনায় আহত মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসেন (২৪), পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সুলতান মাহমুদ (২৩) ও সাজুকেও (২৪) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাকিব ও সুলতানের বাম পায়ে গুলি এবং সাজুর ডান পায়ে ককটেলের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। সুলতান ও সাজু চিকিৎসা নিয়ে গতকাল শনিবার সকালে বাড়ি ফিরে গেছেন।

চিকিৎসাধীন রাকিব বাংলামেইলের কাছে দাবি করেন, গত বৃহস্পতিবার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক উজ্জল খান ও তার সহযোগী একটি ছিনতাই করে। এ বিষয়ে কথা বললে সুইন ও তার গ্রুপের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। উজ্জ্বল সভাপতি পল্লবের গ্রুপের অনুসারী। এ কারণে পল্লবের গ্রুপের কর্মীরা এ হামলায় অংশ নেয়। তারা ককটেল ফাটিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। এতে তাদের গ্রুপের কর্মী ফারুক মারা যান।

তবে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র বাংলামেইলকে জানান, সাধারণ সম্পাদক সুইমের পক্ষের কয়েকজন অনুসারী (নর্থ হলের বাসিন্দা) সাউথ হলের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী উজ্জ্বলকে তার কক্ষে ঢুকে লাঞ্ছিত করে। এ নিয়েই সংঘর্ষের সূত্রপাত। সভাপতি পল্লবের ঘনিষ্ঠজন উজ্জ্বলকে লাঞ্ছিত করায় তার কর্মীরা গিয়ে সুইমের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। দু-পক্ষের মধ্যে এসময় গুলি বিনিময় হয়। পরে ফারুকের মৃত্যুর খবরে তার বন্ধুরা নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে।

সূত্র জানায়, পলাশ নামে সুইমের এক বন্ধুসহ দু'জন নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে হলে ফিরছিলেন। এসময় পল্লবের অনুসারী সহসভাপতি হেমায়েত এবং সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল তাদের কাছে চাঁদার ভাগ চান। তারা টাকা দিতে অস্বীকার করলে প্রথমে তাদের মারধর ও পরে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন এবং টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। বিষয়টি জানার পর হেমায়েত ও উজ্জ্বলকে নর্থ হলের সামনে ডেকে নেন সুইমের লোকজন। এরপর সেখানে মীমাংসা চেষ্টার একপর্যায়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।

পাঁচদিন আগে একটি চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল।

সাকিবুল হাসান সুইম বাংলামেইলকে বলেন, ‘উজ্জ্বল খানকে কিছুদিন আগে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে তার বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে তাকে ফোন করা হলে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। পরে উজ্জ্বল বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে হামলা চালায়।’

ফারুকের রুমমেট সাব্বির আহসান মামুন জানান, ক্যাম্পাসে রাজনীতি ও মারামারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না ফারুক। ঘটনার সময় তিনি হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসময় পল্লব-উজ্জল গ্রুপের কর্মীরা গোলাগুলি শুরু করলে ফারুক গুলিবিদ্ধ হন।

পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা

কলেজ ক্যাম্পাসে গুলি ও এক ছাত্র হত্যার পরও এ ঘটনায় কাউকে আটক করেনি পুলিশ। ঘটনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল কেউ মুখও খুলছেন না। জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হাসান সর্দার বাংলামেইলক বলেন, ‘কী নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছির আরাফাত বলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে একটি গণ্ডোগোল হয়েছে। এর বেশি কিছু এখনো জানা যায়নি। মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার করা হবে।’

তিনি আরও জানান, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হাসান সুইম বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। এতে উজ্ঝল খান, আঞ্চুল, আজিজ, চয়ন, হেমায়েত, শহীদুজ্জামান, শুভ্রদেব, আলী খান, ইকবালসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।  

এদিকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ড. আয়েশা বেগম বাংলামেইলকে বলেন, ‘ফারুকের মৃত্যুর ঘটনায় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুফিয়া বুলবুলকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া কলেজের পক্ষ থেকে ফারুকের পরিবারকে সাধ্যমত আর্থিক সহায়তা করা হবে।’

দরিদ্র পিতার স্বপ্নভঙ্গ

গতকাল শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ফারুকের লাশ গ্রহণ করেন তার চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম মিলন। তিনি জানান, পঞ্চগড় শহরের চিনিকল এলাকায় তাদের বাড়ি। ফারুকের বাবা মুনির হোসেন চিনিকল জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন। ফারুক চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। পরিবারটির আশা-ভরসার স্থল ছিলেন তিনি।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে ফারুকের বাবা মুনির হোসেন কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছি। আশা ছিল, সে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। সংসারের অভাব দূর হবে। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হলো না।’

তিনি জানান, ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ফারুক স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে চাকরির পরীক্ষার জন্য ১০ দিন আগে ঢাকায় আসেন তিনি।

জয় পরাজয় আরো খবর

adv
সর্বশেষ সংবাদ
সাক্ষাতকার
adv
সব জেলার খবর
মুক্তমত
আর্কাইভ
December 2013
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  


বিজ্ঞাপন দিন

adv

মিডিয়া