adv
১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

’সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয় না’ কিšত্মু নতুন প্রজন্ম এর বিরুদ্ধে একাট্টা

06হিন্দু নির্যাতনের সর্বশেষ খবর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বালাবাড়ি গ্রামের ২০টি হিন্দু বাড়ির দরজার সামনে মরা গরুর মাথা ও হাড়গোর ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা। একই সময় গ্রামের মন্দিরের চুলা ভাঙচুর করে সেখানেও গরুর মাথা ও হাড়গোর ফেলেছে তারা। রোববার গভীর রাতে কোন এক সময় এ ঘটনা ঘটে। এতে গ্রামটির হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে এভাবে আঘাত হেনে এলাকা ছাড়া করার পাঁয়তারা করছে জামায়াতের লোকজন। এর আগেও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা এভাবে গ্রামের মন্দিরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে বলে অভিযোগ (ইত্তেফাক, ১৯ নভেম্বর ‘১৩)। 
 
এর আগে লালমনিরহাটের পাট গ্রামে, পাবনার সাঁথিয়ায়, বরিশালের শহর সংলগ্ন চরকাউয়ায়, কুষ্টিয়া, দিনাজপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, জ্বালিয়ে দেয়া, মন্দির ভাঙচুর এবং শারীরিক নির্যাতনের সাম্প্রতিক সচিত্র খবর মিডিয়াগুলোতে এসেছে।
 
এই হামলা-নির্যাতন থেকে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও তাদের গির্জা এবং প্যাগোডাও বাদ পড়েনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা, রামু ও উঁথিয়া তার বড় দৃষ্টাšত্ম।
 
সংখ্যালঘু এবং বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর এই নির্যাতনের সংস্কৃতি নতুন নয়। এটা পাকি¯ত্মান আমলেরই ধারাবাহিকতা। পাকি¯ত্মান আমলে দেখা গেছে ভারত-পাকি¯ত্মানের রাজনৈতিক সম্পর্ক যখনই টানাপড়েনের মধ্যে উত্তপ্ত অবস্থায় গিয়েছে কিংবা ভারতের কোন এলাকায় যখন কোন হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিত, তখনই তার প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ ঘটত পশ্চিম ও পূর্বপাকি¯ত্মানের হিন্দু সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। এই চেতনার ধারাবাহিকতার প্রকাশ দেখি স্বাধীন বাংলাদেশেও। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর টুকটাক সাম্প্রদায়িক নির্যাতন স্বাধীনতার পর থেকেই গ্রামগঞ্জে ছিল। নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ত্যাগের প্রবণতা হিন্দুদের সবসময়েই ছিল এবং আছে।
 
তবে সবকিছুতে ছাড়িয়ে গেছে ২০০১ এর নির্বাচনোত্তর সেই সময়কার সরকারের হিন্দু নির্যাতনের দৃশ্যপট। ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন-২০০১, গণতদšত্ম কমিশনের প্রতিবেদন’ পড়লেই এর ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাবে। এ যেন পাকি¯ত্মানি প্রেতাত্মারাই ভর করেছিল শাসকগোষ্ঠীর ওপর। এদের সক্রিয় নীরবতায় নিষ্ঠুরতা-নৃশংসতা এবং পৈশাচিকতার লজ্জাজনক দৃষ্টাšত্ম ফুটে উঠেছে প্রতিবেদনটির পাতায় পাতায়।
 
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১ এর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর এ দু মাসে ঢাকা বিভাগে ১১২টি, রাজশাহী বিভাগে ৫৯টি, খুলনা বিভাগে ৯৭টি, বরিশাল বিভাগে ৬১টি, সিলেট বিভাগে ৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৯১টি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় আক্রাšত্ম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনমূলক ঘটনার সংখ্যা ৩৩২টি। খুন হয়েছে ৩৪ জন। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ১২২ জন। আহত ১৪০২ জন। হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটেছে ১২৮টি ও অন্যান্য অপরাধ ৩২টি। ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ধ্বংসের ঘটনা ১৩৭৭টি। দেশ ত্যাগ করেছে বরিশালে ১৬ হাজার, চট্টগ্রামে ১০ হাজার, ভোলায় ২ হাজার ২০০, বাগেরহাটে ১০ হাজার, ফরিদপুরে ৫ হাজার এবং নোয়াখালীতে দেড় হাজার। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের সংখ্যা সবচাইতে বেশি ঘটেছে ভোলায়, (৬৫) তারপরই রয়েছে বরিশালে (৩৩), যশোর (২০), লক্ষীপুর (২৬)। শারীরিক নির্যাতনের সংখ্যাও বেশি বরিশালে (৩১৮)। এরপর লক্ষীপুর (২৮০), কুমিল্লায় (২৭৪), এবং ভোলায় (২১৪), (গণতদšত্ম কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ১৭৯-১৮০)।
 
এসবের ধারাবাহিকতাই হলো সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা।
 
এসব দেখে শুনেই সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কোন বিচার হয় না’। তাদের ওপর নির্যাতন করে যে কেউই পার পেয়ে যায় (ইত্তেফাক, ১২ নভেম্বর ‘১৩)। ‘বাংলাদেশে নির্বাচন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা’ শীর্ষক এই সেমিনারে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সাতটি দেশের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। এখানে নির্যাতনের তথ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। বক্তারা বলেছেন, সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়ার ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত সবাই জড়িত। হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের বিষয়ে কারো হাতই পরিষ্কার নয়। শুধু বেস্নম গেম ছাড়া।
 
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বা আরও স্পষ্ট করে বললে, অমুসলিম নির্যাতনের কয়েকটি মাত্রিকতা রয়েছে। এর পেছনে যেমন রয়েছে সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের সমর্থন, সময়ের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, ভোটের রাজনীতি, লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি। এগুলোর প্রভাব থেকে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ মনোজগতিকভাবে মোটেই প্রভাবমুক্ত নয়।
 
ভারতের সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আমাদের এখানের মৌলিক পার্থক্য হলো, ভারতে হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আমাদের হয় ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন। সেটা গুজরাট বলেন, উত্তর প্রদেশ বলেন, বিহার বলেন কিংবা পশ্চিম বঙ্গ বলেন, ওখানে দাঙ্গা হয় প্রায় সমানে সমান। মসজিদ ভাঙলে তো মন্দিরও ভাঙা হয়। এমনকি দুঃখজনক এবং ইতিহাসের আর এক জঘন্য কলঙ্কজনক ঘটনা বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ভারতে প্রথম হামলা মন্দিরেই হয়েছিল। এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখা দিলে হিন্দুরা পর্যšত্ম পালিয়ে যায় জীবন বাঁচাতে। যা আমাদের এখানে ভাবাও সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কোন সংখ্যালঘু কোন সংখ্যাগুরুর ঘরবাড়ি হামলা করেছে, আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বা গায়ে কাঁটার একটি আঁচড়ও দিয়েছে বা মসজিদ অপবিত্র করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে এমন দৃষ্টাšত্ম দুর্লভ বললেও ভুল হবে। একদম অসম্ভব। এ কারণেই পাকি¯ত্মান ও বাংলাদেশে একপেশে হিন্দু নির্যাতন চলে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না।
 
ভারতের বিকশিত গণতান্ত্রিক বাতাবরণে সেখানকার সংখ্যালঘুদের বিশাল ক্ষমতায়ন ঘটেছে। ভারতের মুসলমান সমাজ নিজেদের মনে প্রাণে ভারতীয় মনে করেন এবং তারা ঐক্যবদ্ধ। সর্বভারতীয় সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান এতই শক্তিশালী যে তারা ভারতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। তারা অধিকার সচেতন। ‘৪৭ এর পর থেকে ভারত থেকে কত শতাংশ মুসলিম পাকি¯ত্মান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসেছেন বা আসছেন এবং বাংলাদেশ থেকে কত শতাংশ হিন্দু ভারতে গেছেন এবং যা”েছন পর্বত প্রমাণ পার্থক্যের এই হিসাবটা দেখলেই বোঝা যায়। পাকি¯ত্মানে এখন ২ শতাংশ হিন্দু আছেন কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশেও এমনকি একাত্তরে হিন্দুদের যে সংখ্যা ছিল, আজ তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর পেছনে একদিকে যেমন বাঙালি মুসলিম মধবিত্তের চেতনায় দার্শনিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ইতিহাস চেতনার সক্রিয় বহমানতা, অন্যদিকে রাজনীতি ও ভোটের রাজনীতির বিভিন্ন সমীকরণের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতিই ক্রিয়াশীল। অন্যদিকে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে জাত পাতের কারণে অনৈক্য, ‘৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই বি”িছন্নতাবোধ উৎকট ভারতমুখিতা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। সংখ্যাগুরুর শ্রেয় বোধের ওপর অসহায় নির্ভরশীল থেকেই হিন্দু সংখ্যালঘুরা দিনকে দিন ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ছেন।
 
ভারতের মুসলিমদের ওপর আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নির্যাতন যে চলছে না তা মোটেই বলা যাবে না। কোন কোন স্থানে তারা রাজনীতির চরম উদাসীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগবঞ্চিত ব্যাপক বৈষম্যেরও শিকার। তবে আমাদের সঙ্গে পার্থক্য হলো, তারা অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ সচেতন, সংগঠিত এবং শক্তিশালী। বি”িছন্নতাবোধে (অষরবহধঃরড়হ) তারা দুর্বল হয়ে যায়নি। তারা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের প্রতি ভারতের রাষ্ট্রশক্তির ধারাবাহিক উদার নীতি সমর্থন, কর্মসূচি এবং তার বা¯ত্মবায়ন। এক ভারতের বিজেপিতেই রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রচুর নেতা ও কর্মী এবং সমর্থক। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী বা অন্যান্য ইসলামিক দলে হিন্দুসহ কয়জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন কেউ বলতে পারবেন কি। একজনও নেই। থাকা সম্ভব নয়। কারণ এসব দলের বিশ্বাসের দার্শনিক মন¯ত্মত্ত্বে অমুসলিমদের অ¯িত্মত্বই স্বীকার করা হয় না। এদের বিতারণই একমাত্র আরাধ্য তাদের। যদিও মোটেই তা ইসলাম সমর্থিত নয়। এর বড় প্রমাণ তো আজকের পাকি¯ত্মানসহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিমদের অবস্থান এবং সংখ্যা।
 
প্রায় সাড়ে ৬০০ বছরের তুর্কি ও মুঘল শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজ আগমনে এ উপমহাদেশের মুসলিমরা নিজেদের ক্ষমতাহীন ভাবতে শুরু করেন। শাসক থেকে শাসিতের বোধ মন¯ত্মাত্ত্বিকভাবে তাদের মনোজগৎকে আ”ছন্ন করে রাখে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভেদনীতি তাদের আরও কোণঠাসা করে দেয়। এ থেকে সৃষ্ট বোধের ধারা ক্রমশ ক্লিস হয়ে আসলেও পাকি¯ত্মান থেকে বাংলাদেশে মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে আজও বহমান। একদিকে আইডেনটি ক্রাইসিস এবং অন্যদিকে এর থেকে সৃষ্ট উৎকট স্বাতšত্ম্র্য চেতনা এবং জীবনবোধ মুসলিম মধ্যবিত্ত মানসের স্বাতন্ত্রিক চেতনাকে এখনও উজ্জ্বলিত করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ এই চেতনায় প্রচ- ধাক্কা দিলেও একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত চেতনায় তা গভীরে প্রথিত হতে পারেনি। এটাই হলো আমাদের চিšত্মায় ও চিšত্মনে সাম্প্রদায়িকতার অ¯িত্মত্ত্বর শিকড়। নাগরিক ভাবনা, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ বোধ এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে তা হয়তো সুপ্ত থাকছে কিš‘ তা বিলীন বা উৎপাটিত হয়ে যায়নি আজও।
 
প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ ভারতে উনিশ শতকের শেষ পাদ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি সংখ্যালঘু অজ্ঞ-অনজ্ঞর, নিঃস্ব, নিরন্ন চাষি মজুরবহুল দেশজ মুসলিমদের নওয়াব, মালিক, পীর, স্যার শ্রেণীর ধনী-মানী-শিক্ষিত নেতারা ব্রিটিশ আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে, কৃপায় করুণায়, দাক্ষিন্নে ধন্য ও নিরাপদ থেকে নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের, নিম্নবিত্তের ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও তু”ছ স্বল্প আয়ের পেশাজীবীর শিক্ষিত সšত্মানদের জন্য সরকারি চাকরিতে কিছু সংরক্ষিত পদ এবং উনজন হিসেবে স্বতন্ত্র নির্বাচন মাধ্যমে নিজেদের জন্য কিছু, সদস্য ও মন্ত্রী পদপ্রাপ্তিই ছিল মুসলিম লীগের কার্যধারার লক্ষ্য। কংগ্রেসের মতো স্বাধীন ভারতের প্রয়োজনে কোন সুপারিকল্পিত চিšত্মা-চেতনা-কর্মসূচি ছিল না ১৯৩৫ সাল অবধি মুসলিম লীগের। অতএব মুসলিম লীগের স্বাতšত্ম্র্য চেতনার বি”িছন্নতা বুদ্ধির, সাম্প্রদায়িক দ্বেষ-দ্বন্দ্বের একটা সঙ্গত কিংবা অসঙ্গত ব্যাখ্যা মেলে। (মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা, পৃষ্ঠা ১৬)
 
এই ইতিহাস চেতনা প্রভাবক হয়ে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এবং তার জন্ম বাঙালির মানস জগৎকে এক নতুন চেতনার সৃজনে উদভাসিত করে দিয়েছে। নতুন প্রজন্ম তাতেই স্মাত। কিš‘ মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থানে সীমাবদ্ধ। এদের নতুন প্রজন্মের ভাষা, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন এবং চাওয়া-পাওয়া উপলব্ধিতে নেই। বাংলাদেশে আজকে এটাই প্রধান সংকট। অর্থাৎ গ্যাপ বিটুইন নেতৃত্ব এবং নতুন প্রজন্ম। এই সংকট রাজনীতিতে, এই সংকট সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনায়।
 
ফলে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার খেলায় সংখ্যালঘুরা শুধু ব্যবহৃত হয়েই আসছে। আর নেতৃত্ত্বর, প্রাতিষ্ঠানিক কেষ্ট-বিষ্টুদের উদারতা প্রদর্শনই হয়ে আসছে অসাম্প্রদায়িকতা বিচারের মাপকাঠি। অধিকারের চেতনা বোধ থেকে সংখ্যালঘুদের বিচার শুধু শাসনতন্ত্রে ও অন্যান্য কাগজ কলমে এবং বক্তৃতাবাজিতেই বিদ্যমান। এখনও হিন্দুদের দুর্গা পূজা করতে হয় কঠিন কঠোর নিরাপত্তা চাদরের মধ্যে। এ যেন পবিত্র আমানত। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এই বোধ সত্যিকার অর্থে মধ্যবিত্ত মুসলিম মানসের মধ্যে কতদূর প্রথিত তা প্রশ্নবিদ্ধ। সামান্য ধর্মীয় উসকানিতেই এখানে ঘটে যায় বিশাল নৃশংস সংখ্যালঘু নির্যাতন। সামান্য ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে নিমিষেই পুড়িয়ে দেয়া হয় পনেরো বিশটি সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরবাড়ি। সুতরাং যে মানসে, সে উদ্দীপনার বিচারে এই সহিংসতা ঘটানো হয় তাকেই তো আঘাত করা দরকার। সেটা কখনো পুলিশি উদ্যোগে এবং স্বাতন্ত্রিক ধর্মীয় বোধ উজ্জীবিত রেখে সম্ভব নয়। এটা একমাত্র সম্ভব ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পুরোপুরি বিযুক্ত করার মাধ্যমেই। ধর্ম অত্যšত্ম পবিত্র। তা থাকবে মানুষের হৃদয়ে, ব্যবহারিক আচরণে এবং তার অনুশাসনের নিজ নিজ আপন উদ্যোগে। স্বাধীনতা উত্তর গড়ে ওঠা নতুন আধুনিক প্রজন্ম এটাই চান। তারা সাম্প্রদায়িকতার ভেদনীতি মানতেও চান না। ভাবতেও চান না। কিš‘ রাজনৈতিক নেতৃত্বই নতুন প্রজন্মের চলার পথে এখন প্রধান বাধা। সুতরাং নব প্রজন্ম চলছে নিজেদের মতো করে। কোন আলোকবর্তিকা নেই তাদের সামনে। কোন দিশা নেই। কোন নেতৃত্ব নেই। এরা চলছে নেতৃত্বহীন হয়ে, অভিভাবকহীন হয়ে। এই সংকট দ্র“ত কাটাতেই হবে।
 
গ্রামগঞ্জে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণটি হলো মূলত অর্থনৈতিক। কায়েমি স্বার্থের বরকন্দাজ হিসেবে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হিন্দু নির্যাতন করছে মূলত এদের তাড়িয়ে সম্পত্তি দখল করার জন্য। এমনিতেই হিন্দুরা দিনকে দিন গ্রামগঞ্জ ছেড়ে নিকটস্থ শহরে কেন্দ্রীভূত হ”েছ। ওখান থেকেও তাড়িয়ে দিতে পারলে কায়েমি স্বার্থই লাভবান হয়। এ কারণেই কায়েমি স্বার্থ ধর্মীয় উসকানি দিয়ে সংখ্যালঘু র্নির্যাতনের ঘটনা ঘটা”েছ। এ প্রশ্নে দল-মত, আদর্শ, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাসের কোন বালাই নেই। সব একাকার কায়েমি স্বার্থের কাছে।
 
তবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। শুধু ঢাকায় বা বড় বড় শহরে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বড় বড় ফিনফেনে সেমিনার, শোভাযাত্রা, লংমার্চ করার মধ্যেই তারা থাকছে না। কারণ এর দ্বারা ওই প্রত্যšত্ম অঞ্চলের সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের কোন বার্তা পৌঁছবে না। ওখানের সহিংসতার ডাইনামিকস ভিন্ন। যা তথাকথিত এই এলিট ভাবনায় প্রভাবিত ওইসব সেমিনার সিম্পোনিয়াম আয়োজনের উপলব্ধিতে আসবে না। সুতরাং সারাদেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ব্রিগেড গড়ে তোলার নতুন প্রজন্মের আহবান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উদঘাটন করল। যেদিন বেলকুচিতে ২০ হিন্দুর বাড়ির সামনে গরুর মাথা ও হাড়গোর রাখার খবরটি বের হয়, সেদিনেই এই ব্রিগেড গড়ার আহ্বানের খবর প্রকাশিত হয়। তাদের মশাল মিছিলের প্রজ্বলিত আলো সব সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধে নামতে মানুষের শ্রেয় বোধকে আলোকিত করবে। মনের ধোঁয়াশা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে দেবে। সুতরাং এটাই বাংলাদেশ। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
 
একদা রবীন্দ্রনাথ সর্বত্রই হত্যালীলা দেখেছিলেনথ হত্যা অরণ্যের মাঝে/হত্যা লোকালয়ে/হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে/কীটের গহ্বরে অগাধ সাগর জলে/নির্মল আকাশের/হত্যা জীবিকার তরে/হত্যা খেলা”ছলে/হত্যা অকারণে/হত্যা অনি”ছার ফলে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্র নামের এই দেখাকে এবার মিথ্যা প্রমাণ করবেন।

জয় পরাজয় আরো খবর

adv
সর্বশেষ সংবাদ
সাক্ষাতকার
adv
সব জেলার খবর
মুক্তমত
আর্কাইভ
November 2013
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  


বিজ্ঞাপন দিন

adv

মিডিয়া