adv
২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ যেমন করে গাইছে আকাশ || টোকন ঠাকুর

tokonঅনেক সময়ই এমন হয় যে, আমরা হারিয়ে ফেলার পর এক ধরনের বুঝতে পারি, হারানোর আগে ঠিক টেরই পাই না। হারানোর পর বুঝতে পারি, আর তো পাব না। খুঁজেও পাব না। শত কামনাতেও পাব না যখন, তখনই বোধোদয় হয়, কাঞ্চন-সোনাঝুরি দিন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সেই দিন ফিরে পাব না। বুঝতে পারি, বিকেলের নদী বয়ে গেছে নিজের মতোই, আমরা দেখিনি। আমার শিক্ষক ছিলেন কবি-গল্পকার অধ্যাপক শহীদুর রহমান। আমার কলেজে পড়া দিনে আমি তাকে পেয়েছিলাম। কত কিছু যে জেনেছি-শিখেছি শহীদ স্যারের কাছে, কোনোদিন কোথাও তা লিখিনি তেমন করে। পরে, ঢাকায় এসে খুব মিশেছিলাম লেখক-চিন্তুক আহমদ ছফার সঙ্গে। ছফার কাছে শিখেছি বাংলাদেশ। ছফা ভাইকেও খুব অকালে হারিয়েছি আমরা। আহমদ ছফার প্রয়াণের পর খুব কেঁদেছিলাম। খুব মন খারাপ হয়েছিল আমার। ছফার মৃত্যু আমাকে প্রিয়জন হারিয়ে ফেলবার বেদনা দিয়েছে, এখনো দেয়। আস্তে আস্তে হারানোর তালিকা দীর্ঘ হয়। হারাই সম্পর্ক, হারাই সময়। হারাই হারাই জীবন যায় আমাদের। একদিন কাইয়ূম চৌধুরী হঠাৎ চলে গেলেন। কষ্ট পেয়েছি।
শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী আমার শিক্ষক ছিলেন। চারুকলায় পড়েছি বলে দেশের প্রায় সব খ্যাতিমান শিল্পীই আমার শিক্ষক, এ আমার সৌভাগ্য। কাইয়ূম স্যার মারা গেলেন বছর দুই আগের এক শীতে, ঢাকা সেনানিবাস স্টেডিয়ামে, বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টিভালের মঞ্চে। মিউজিক নিয়ে কথা বলতে বলতেই তিনি ঢলে পড়লেন মঞ্চে। কাইয়ূম চৌধুরী চিত্রশিল্পী। শিল্পীর এমন বর্ণাঢ্য প্রস্থান আগে দেখিনি আমরা। কাইয়ূম স্যারের বন্ধু হক ভাই। সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষার সব্যসাচী লেখক। কয়েকদিন পর হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার আড্ডা। বললেন, ‘কাইয়ূমের চলে যাবার খবর ফোনে দেওয়া হয়েছে আমাকে, ঢাকা থেকে।’
বললাম, ‘ছিলেন কোথায়?’
‘ত্রিপুরায়। একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। তোমার ভাবি আর আমি ত্রিপুরাতে গেলাম। কাইয়ূমের চলে যাওয়াটা কষ্ট দিচ্ছিল।’

‘অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কি ঠিকঠাক যোগাযোগ আছে আপনার?’ আমার এই প্রশ্নটা ছিল এমনিই, এখানে লিখব এমন কোনো ধারণা ছিল না সেদিন। হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার ক্যাজুয়াল আড্ডার একটা সম্পর্ক কীভাবে যে হয়ে গেল, সেটাও জানিনে। এমন কি কিছুদিন বাসায় যাওয়া না হলেই হয়তো একদিন ফোন করে লেখক-ডাক্তার এবং হকের স্ত্রী, যাকে আমি আনোয়ারা আপা বলেও ডাকি, ভাবিও বলি, তিনি বলেন, ‘বাবু শোনো, তোমার হক ভাইয়ের শরীরটা দুদিন ভালো যাচ্ছে না। তুমি কি একটু আসবে?’

গিয়ে দেখি, হক ভাই হয়তো তার বাড়ির দোতলা দিয়ে নিচের ড্রইংরুমে আসছেন, আমি বসে আছি, হক ভাই এসে বসলেন। হয়তো হালকা কাঁশি দিচ্ছেন। কাঁশিটা বাড়ছে, কমছে। কিন্তু কাঁশি তাকে কাবু করতে পারার কথা নয়। আমাদের আড্ডা শুরু হয়ে যায়। কত না কথা হয়। কথা দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে যায়। কথার সঙ্গে ছুটি আমরাও। একটু থামি। চা পান করি। লুচি আর আলুর দম আসে। আমরা খেতে খেতে কথা বলি। বাংলাভাষার সব্যসাচী কবির সঙ্গে কথা জমে ওঠে। ধীরে ধীরে কথার মধ্যে কবিতা ঢুকে পড়ে। ছোটগল্প ঢুকে কথার পড়ে। আলাপের আলপথ ভেঙে যায়। সিনেমা ঢুকে আলাপের পড়ে। হাওয়া হই হই করে ঢুকে পড়ে ‘মঞ্জুবাড়ি’তে। গুলশানে সৈয়দ হকের বাড়ি, বাড়ির নাম ‘মঞ্জুবাড়ি’। হাওয়া ঢুকে পড়ে জানলা দিয়ে। সেই সময় উপমহাদেশ-দেশভাগের ইতিহাস ঢুকে পড়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। ১৯৪৯ সালের ছিমছাম শহর ঢাকা ঢুকে পড়ে হকের কথার মধ্যে। কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে সৈয়দ হকের বাল্যবেলা, কুড়িগ্রাম, তেতাল্লিশের মন্বঃন্তর। মানুষের কঙ্কালসার লাশ ঢুকে পড়ে আলাপের মধ্যে। দেশভাগ পরিসর বাড়িয়ে দিয়ে যায় আমাদের আলোচনার। মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য অধ্যায় হয়ে ঢুকে পড়ে কথায়, আলোচনায়, আড্ডায়। আলাপের মধ্যে অটোমেটিক প্রবেশ করেন সৈয়দ হক যাদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, সেই মহান বাঙালিগণ- কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান বা হকের বন্ধু চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান, নির্মাতা আলমগীর কবীর। তিনি তার প্রয়াত কবি বন্ধু লেখক-সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, কবি শামসুর রাহমানের কথা বলেন। শামসুর রাহমানের মৃত্যুতে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। বন্ধুর মৃত্যু তাকে ব্যথা দিয়ে যায়। কবিবন্ধু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কথা বলেন। আর বলেন, ‘ফোনে শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথা হয় মাঝেমধ্যে।’ শহীদ কাদরী তখনো আমেরিকায় থাকতেন এবং কাদরীও প্রয়াত হলেন গত মাসেই। সেই সময়টায় হক ছিলেন লন্ডনে, কর্কট রোগ দূরীকরণ চিকিৎসায়। ঢাকায় আমরা ছিলাম উৎকণ্ঠায়। লক্ষ বাঙালি পাঠক তার। দুঃশ্চিন্তা বেশি পাঠকের। দুঃশ্চিন্তা কম নয় স্বজনের। কবির স্বজন! আসলে কবির স্বজন কারা? তার পরিবার-পারিপার্শ্বিক মানুষ, নাকি কবিকে বা লেখককে যারা পাঠ করে তাকে চিনে নিয়েছেন, কবির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন, তারা? এই প্রশ্ন শুধু প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়। এই প্রশ্নের সদুত্তর দেয় না কেউ। সৈয়দ হককেই এই প্রশ্ন করা যেত, আমি করতাম, ‘আচ্ছা হক ভাই, স্রষ্টার স্বজন কারা?’
গত মাসে, গত আগস্টের শেষে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে শহীদ কাদরী আমেরিকায় প্রয়াত হলেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কবির শবদেহ ঢাকায় পৌঁছুল, আগে থেকেই টিকিট-শিডিউল থাকায় সেদিন আমি কোলকাতায় ছিলাম। মনটা ব্যাকুল ছিল শহীদ কাদরীর জন্যে, যে কবিকে আমাদের প্রজন্ম ঢাকায় দ্যাখেনি কখনো। কারণ, তিন দশকেরও অধিক সময় শহীদ কাদরী প্রবাসে থেকেই মারা গেলেন। কাদরী ছিলেন সৈয়দ হকের আরেক বন্ধু, সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে, যৌবনের সূচনাকাল থেকেই, পুরোনো ঢাকার বাংলাবাজারের ঐতিহাসিক ‘বিউটি বোর্ডিং’ এর দিনগুলো থেকেই। আর কানাডা থেকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন কবি-অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হকের আরেক বন্ধু। প্রশ্ন করি, ‘আমি কি আপনার বন্ধু?’
‘বন্ধু তো বটেই। নইলে আড্ডা হয় নাকি?’
হকের বাড়ি ‘মঞ্জু বাড়ি’। গুলশান ১ এর ৬ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটা। বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়ি। এদেশে কোনো কবির এইরকম রাজকীয় বসবাস আর দেখিনি। রাজা তিনি, রবীন্দ্রনাথ তিনি। আবার তিনিই হচ্ছেন বাউল। হকের দাদার ফকিরি জীবনই কি গোপন জিনের দাবিতে সাহিত্য-সমগ্র প্রকাশে ঠেলে দিয়েছিল সৈয়দ শামসুল হককে? সে প্রশ্ন করা হয়নি আমার। বুঝিনি তো, তিনি এইভাবে হঠাৎ চিরদিনের মতো চলে যাবেন?

তো কোলকাতায় রবীন্দ্র সদনে চলছিল ১০ দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ বইমেলা’। মঞ্চ করা হয়েছে বইয়ের স্টলগুলোর পাশে। মঞ্চের সামনে শ’ দেড়েক দর্শক। দর্শক বলতে কোলকাতার বইপ্রমী আর স্মৃতিতে বাংলাদেশ বহন করা বাঙালিরা। যারা একদিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিল এবং বর্তমানে ভারতীয়। সবই দেশ বিভাগের কুফল। দেশ বিভাগের সময়কার ইতর রাজনীতিবিদদের ইতরামির ফল। সেই ইতরামি জীবন দিয়ে খেসারত দিতে হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালিকে। রাজনীতিবিদদের নষ্টামি কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটাতে পারে, চোখের সামনে তার একটি বড় দৃষ্টান্ত ১৯৪৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙে টুকরো করে ফেলল! ভাঙনের সেই ক্ষত পোষায়নি আর। ক্ষত কেবল বেড়েছেই। 

তো দূর থেকে দেখলাম, কলকাতা বইমেলার অনুষ্ঠান মঞ্চে বসে আছেন কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়, রবিউল হুসাইন, তারিক সুজাত এবং আরো দুইজন আমার অচেনা মানুষ। তারাও হয়তো কবি, পশ্চিমবঙ্গের হতে পারেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছে আমাদের কবি পিয়াস মজিদ। কিন্তু মঞ্চে ছিলেন আরেকজন কবি, যার সঙ্গে আমার ঢাকায় কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। যদিও ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা বন্ধু, পরস্পরের লেখা পড়েছি, স্ট্যাটাস পড়ে থাকি। ফটো দেখে থাকি। সুদর্শন তিনি। ফেসবুকে ফটো দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই অনেকটা দূর থেকে আমি দেখলাম, বসে আছেন কবি মাহবুবুল হক শাকিল। তিনিও আমাকে দেখলেন এবং আমাদের মধ্যে দূর থেকেই ইশারা ভাষায় ভাব বিনিময় হলো। এরপর তিনি পিয়াসকে কাছে ডেকে কী যেন বললেন এবং পিয়াস ফের ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে আমার নাম ধরে দুইবার ডাকল। আমি রবীন্দ্র সদন চত্বরে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে চা গিলে যখন একটা বিড়ি ধরিয়েছি, আবার পিয়াস মাইকে আমার নাম ডাকল, মঞ্চে উঠলাম। কবি মাহবুবল হক শাকিলের পাশের চেয়ারে বসলাম। দর্শকসারির প্রথম লাইনে তখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের প্রকাশক সাহিদুল ইসলাম বিজু, মাজহার ভাইসহ অনেকেই। আমি একটি ছোট্ট কবিতা পড়েছি, ওটাই একমাত্র কবিতা আমার, যেটা মুখস্থ থাকে। কবিতার নাম, ‘ভূগোলমাষ্টার’। 
‘এই আকাশ আমার পিতা
মাটি আমার মা 
আমি তাদের সন্তান, ওই দিগন্ত।
কিন্তু ভূগোলমাষ্টার বলছেন-
দিগন্ত একটি ধারণামাত্র।’

কিছুক্ষণ আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। জানি, তিনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রের লোক। আমার এও জানা আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে থাকাকালীন চিকিৎসাধীন কবি সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে গেছেন, সময় দিয়েছেন শুশ্রুষার মায়ায়, ভালোবাসায়। তাই, সেই মুহূর্তে কবি মাহবুবুল হক শাকিল, কবিদের নিজস্ব বংশে তিনি আমার ভাই, হক ভাই যেমন ভাই, শক্তি-বিনয় যেমন ভাই, সুনীল-শরৎ যেমন ভাই, রণজিৎদা, মৃদুলদা যেমন ভাই, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ যেমন ভাই, নেরুদা-বোদলেয়র যেমন ভাই। মালার্মে যেমন ভাই। পাজ যেমন ভাই। লালন যেমন ভাই। সখা সখা ভাই। সেটা একটা অনুভূতির অংশ। সেই অংশ থেকেই মঞ্চে বসা সেই ক্ষণমুহূর্তের সুযোগে আমি জানতে চাইলাম, ‘আমি তো লন্ডনে যোগাযোগ করতে পারছি না, হক ভাই কেমন আছেন?’
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের লোক মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, ‘লন্ডনের ডাক্তার কেমো দিয়েছেন, সব কিছুই এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছে।’
‘ঠিকাছে। কোলকাতায় আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। ঢাকায় গিয়ে একদিন আয়েশ করে আড্ডা দিতে চাই।’ মাহবুবল হক শাকিলের সঙ্গে হক ভাইকে নিয়ে এই ছোট্ট একটি তথ্য আমাকে কেমন নিশ্চিতি দিল, সে মুহূর্তে। কারণ, হক ভাইয়ের সুস্থ্য হয়ে ফেরা দরকার, এটা মনে মনে খুব চাচ্ছিলাম। চাবই তো। কবি তিনি। কবি বংশের অহঙ্কার তিনি। 

এর একটু পর, পাশেই, ‘জীবনানন্দ সভাঘর’-এ আরেক অনুষ্ঠান; কবিতা পড়তে হবে। নিজের কবিতা মুখস্থ থাকে না বলে আমার বন্ধু কবি বিভাস রায়চৌধুরী আমার কয়েকটা কবিতা ফেসবুক থেকে দেখে হাতে অনুলীখন করে এনে দিল। ফলে, নিজের কবিতা দেখে পড়বার একটি ব্যবস্থা আমার হলো। সে ছিল অশোকনগর থেকে প্রকাশিত ‘অহর্নিশ` ছোটকাগজের কুড়িবছর পূর্তি এবং লেখক বেনজীন খান এর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে মধ্যমণি কবি শঙ্খ ঘোষ। পাশাপাশি বসে আছি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। এই প্রথম। এক অন্য ধরনের অনুভূতি। এই সেই কবি, শঙ্খ ঘোষ, আমি যার কত বই পড়েছি। ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’ পড়েছি। ‘গান্ধর্ব বিবাহগুচ্ছ’ ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ ‘জর্নাল’- কত কী পড়েছি। শঙ্খ ঘোষকে তা বললামও অপার মুগ্ধতায়। তিনি ফোন নম্বর দিলেন। আড্ডা হবে শঙ্খ ঘোষের বাসায়, কথা হলো। সেই ফাঁকেই আমি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলাম, ‘সৈয়দ শামসুল হক তো লন্ডনে। জানেন, হক ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে।’
শঙ্খ ঘোষের মুখটা মলিন হলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ফোনে কথা হয়েছে আমাদের।’ 

হোটেল ছেড়ে কলকাতায় কয়েকদিন ছিলাম কলেজের তরুণ শিক্ষক, লেখক, পাতাউজ্জামানের বাসায়। পাতা হচ্ছে রাজীব আহমেদ। ওর বাসা সন্তোষপুরে। সারাদিন কলকাতায় হটি হটি করে ঘুরে রাজীবের বাসায় গেলেই একটা শান্তি। নিজের বাড়িতে থাকার অনুভূতি পেলাম পাতার বাসায়। এত বই-পত্রিকা পাতার ঘরের চতুষ্কোণে! শুধু বই আর বই। বাংলা-ইংরেজি বই। ফিকশন, নন-ফিকশন। যদিও রাজীবের হাতে কবিতা দিয়েই সূচনা, এখন ছোটগল্পে মনোযোগী। খুব ভালো পার্সেপশন রাজীবের। ওকে আমার ভালো লেগেছে। রাজীবকে ভাই হিসেবে পেয়েছি। ওই যে, কবি বংশের ভাই। আর একটা গৃহতথ্য জানাই? রাজীবের রান্নাও খুব চমৎকার। রাজীবের বাসায় থাকলে একটা জিনিস হয়: ঘুরে-ফিরে কথাবার্তায় পড়ে আর্ট-কালচার-চিন্তা-ভারত-বাংলাদেশ-পদ্মা-ইলিশ-ফারাক্কা, ডুয়ার্সের জঙ্গল, ইলিয়াস-শহীদুল জহির-ভৈকম মুহম্মদ বশীর-পশ্চিমবঙ্গ-নন্দন-কফি হাউস-কলেজ স্ট্রিট-যাদবপুর ইউনিভার্সিটি-মমতা-বামফ্রণ্ট-সুমনের গান কিম্বা আড্ডা দিতে দিতে ভোরের পাখির আজান-সবই চলে আসে। এলেন সৈয়দ হকও। রাজীবের খুব ইচ্ছে, আমি যেন সৈয়দ হকের একটা বইতে লেখকের অটোগ্রাফ নিয়ে রাখি ওর জন্যে। ইচ্ছে অপূর্ণ রইল রাজীব, সৈয়দ হক চলে গেলেন, দেখা পাইনি তার। আর পাবও না। একদিন আমি হাসপাতালে গিয়েওছিলাম। হকের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। হকের শরীর সেদিনই চূড়ান্ত ফল করল। 

পাতার সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ। আলাপের অনুঘটক আমাদের কবি রাহেল রাজীব। রাহেলও সেই কবি বংশের ভাই। জগন্নাথে পড়ায়। রাহেলের সঙ্গে গতকালও, ২৮ সেপ্টেম্বর, রাহেল রাজীবের বাসায় হক ভাইয়ের প্রয়াণের একদিন পর, যখন কুড়িগ্রামে তার দাফন সম্পন্ন করে হেলিকপ্টার ফিরল ঢাকায়, সন্ধ্যায়, এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা বলতে বলতেই আনোয়ারা সৈয়দ হককে ফোন দিলাম। ফ্যামিলির সবাই তখন খাচ্ছিলেন। ভাবি ফোনেই কেঁদে ফেললেন, ‘বাবু শোনো, তোমাদের হক ভাই তো অনেক বড় লেখক। আমি মনে হয় তার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি, সেইজন্যে চলে গেল আমাকে রেখে।’
‘না, আপনি তার পাশে ছিলেন, সাথে ছিলেন, সবাই জানে। আমিও জানি।’
মনোবিজ্ঞানের ডাক্তার ও লেখক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক, আমি যাকে আপা বলে ডাকলেও মাতৃত্বের পরিধির মধ্যে দেখি। আনোয়ারা আপা যশোরের মানুষ, আমিও যশুরে, আমাদের সম্পর্ক কত বন্ধনের। এই মানুষটাকে, আনোয়ারা আপাকে আমি কি বলে সান্ত্বনা দেব? সেই ক্ষমতা আমি অর্জন করেছি?
tokon
সৈয়দ হকের সান্নিধ্যে টোকন ঠাকুর (ছবি : সাজ্জাদ হোসেন)

সৈয়দ হক প্রসঙ্গে আমি একটু অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কথাও বলব। আমি তো আর দশজনের মতোই জানি, কবীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্বনামী অধ্যাপক। ইংরেজি থেকে প্রচুর বিদেশী লিটারেচার বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সরকার তাকে সম্মানসূচক পদ জাতীয় অধ্যাপকও করেছেন। এবং ২০১১ কি ১২ সালে ঢাকা ক্লাবের মধ্যের খোলা মাঠে রবীন্দ্র-সার্ধশত পালনের অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ১৫১ জন লেখক একটি করে অর্থাৎ ১৫১ টি রবীন্দ্র বিষয়ে নতুন গ্রন্থ প্রকাশনার এক মহা আয়োজন ছিল। সেই ১৫১ জন লেখককে নিয়েই আয়োজন। এই মহা পরিকল্পনার পরিকল্পক-সমন্বয়ক কবি-অনুবাদক মনজুরে মওলা। আমাদের প্রিয় মওলা ভাই। কবি বংশের জাতক। তো সেই অনুষ্ঠানে হক তো থাকবেনই। রবীন্দ্রনাথ বলে কথা। তাছাড়া মওলা ভাই-হক ভাই সমবয়েসি এবং তাদের বন্ধুত্বের বয়সও প্রায় ছয়দশকের বেশিকাল জুড়ে গড়ে উঠছে। ‘মূর্ধণ্য’ প্রকাশনার আয়োজন সেটি। ঢাকা ক্লাবের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদাত সেলিমও প্রকল্পে জড়িত। দেখলাম, গাড়ি থেকে নামলেন কবীর চৌধুরী। নব্বুয়ের কাছাকাছি তিনি। একা হাঁটতে পারছিলেন না, তাকে ধরতে ছুটে গেলেন ৭৮/৭৯ এর দুই তরুণ। একজন হক ভাই, অন্যজন মওলা ভাই। কবীর চৌধুরীকে একটি টেবিলের পাশের চেয়ারে বসানো হলো। সৈয়দ হক উঠে এলেন, আমি যে টেবিলে বসেছিলাম, সেখানে। আমার কাছেই চলে এলেন। বললেন, ‘এসো।’

সৈয়দ হক আমাকে নিয়ে গেলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কাছে। বললেন, ‘কবীর ভাই, এই যে টোকন, টোকন ঠাকুর।’
‘তাই?’ কবীর চৌধুরী বিগলিত শিশুর মতো প্রায় দাঁত না থাকা গাল খুলে হাসলেন, ‘ধন্যবাদ সৈয়দ। তুমি ওকে কোথায় পেলে?’

কবীর চৌধুরী যে হক ভাইকে ‘সৈয়দ’ বলে ডাকেন, এটা আমার জানা ছিলা না। আমাকে কবীর চৌধুরী বসতে বললেন। আমি একটি চেয়ারে বসলাম। হক ভাই অন্যদিকে গেলেন। কবীর চৌধুরী আমাকে কি বলবেন, সেটা আমি জানি না। আমিই বললাম, ‘স্যার, কেমন আছেন?’
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্বখেদে বললেন, ‘এই বয়েসে আর থাকা। আমি আসলে পত্রিকায় তোমার কবিতা পড়ি অনেকদিন ধরেই। ভালো লাগে। একদিন কথায় কথায় সৈয়দকে বললাম, এই টোকন ঠাকুরকে তুমি চেনো সৈয়দ? এর কবিতা আমার ভাল্লাগে। সৈয়দ বলল, চিনব না কেন? টোকনের কবিতা আমিও পছন্দ করি। আমরা আড্ডা দিয়ে থাকি। ভালোই হলো। আজ ও তোমাকে হাতে নাতে সপে দিয়ে গেল।’

আমার কিছু বলবার থাকার কথাও নয়, নেইও। কিছুক্ষণ কথা হলো কবীর স্যারের সঙ্গে। বললাম, আপনার অনেক অনুবাদের পাঠক আমি। আমার কলেজ লাইফ থেকেই। আমার কবিতা নিয়ে কবীর চৌধুরী আমাকেই বলছেন, ব্যাপারটা কেমন অস্বস্তির না? আমি একটু পরে স্যারকে বলে উঠে গেলাম। স্যার মারা গেলেন কিছুদিন পরেই। মনে অনুশোচনা এলো, ওইদিন আরেকটু সময় কেন কবীর চৌধুরীর পাশে, তার ছায়ায় থাকলাম না? এমন তো না যে, আমি কবিতা নিয়ে আড্ডা কম করি। ভাবতে কেমন যেন লাগে, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিতে তাদের যে দান, তা গ্রহণ করবার সম্পূর্ণ প্রস্তুতিও তো আমার নেই। নেই তো নেইই। কিছুই নেই। আমার একটি সাম্রাজ্য নেই। ব্যাপ্ত কাঠামোতে নির্মিত প্রাসাদ নেই। থাকলে, কবি বংশের কাউকে আর বাইরে থাকতে হতো না। বলতাম, আপনারা সবাই এই প্রাসাদে থাকেন। ঘুমান। ঘুম ভাঙলে উঠে, ভাল্লাগলে কবিতা লিখবেন। সৈয়দ শামসুল হককে বলতাম, আপনি লেখেন পরানের গহীন ভেতর। আমরা থাকব গহীন ভেতর। আমরা থাকব পরানের ভেতর। পরান থাকবে গহীনের ভেতর। ভেতর থাকবে পরানের গহীনে। সেইখানে থেকে যাচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক, কবি বংশের দারুণ অহঙ্কার। সেই অহঙ্কার দান করেন সব্যসাচী হক, বাংলার জনপদে, বাংলাভাষায়। 

কদিন ধরে সবাই বলছে, সৈয়দ হক ‘পরানের গহীন ভেতর’ চলে গেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর, বিকালে। ‘পরানের গহীন ভেতর’ তো সৈয়দ হকের একটি কাব্যগ্রন্থ, যার কবিতাগুলো বাংলা ভাষার পাঠকের স্মৃতিতে ঢুকে পড়েছে। একটা একটু পড়াই যাক-
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি– একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায়৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।


২৮ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে জন্মশহর কুড়িগ্রামের সরকারি কলেজের মাঠের কোণে সৈয়দ হক সমাহিত। ১৯৩৫ এর ২৭ ডিসেম্বর এক কনকনে শীতের ভোরে জন্মেছিলেন যে শিশু, তার বাবা ছিলেন হোমিও ডাক্তার। একদিন সকালে হকের মায়ের যখন প্রসব ব্যথা ওঠে, তখন তাকে দূরের হাসপাতালে নেয়া সম্ভব ছিল না। হকের বাবাই ছিলেন হকের ধাত্রী। বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রতিবেশিরা বলল, ‘এ তো বাদশা!’ 
হক ভাই একদিন কথায় কথায় বললেন, ‘জানো, আমার বাবা-মা, ছোটবেলার বন্ধুরা আমাকে বাদশা নামেই ডেকে থাকে!’

আমার বন্ধু মোহাম্মদ মোস্তফার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম ‘মধ্যমা’ প্রকাশনীতে। গ্রন্থপ্রেমী সঞ্জয় গাইন ছিল, মধ্যমায় চাকরি করত তখন সঞ্জয়। কথায় কথায় মোস্তফা বলল, ‘সিনেমা সিনেমা করো, হক ভাইয়ের খেলারাম খেলে যা নিয়ে সিনেমা বানাতে পারো না?’

এরপর থেকেই সৈয়দ হকের সঙ্গে এক ধরনের ধারাবাহিক আড্ডা আমার শুরু। বসলে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক-চিত্রকলা ঘুরে আলোচনা সিনেমায় এসে থামে। থামে কই? আড্ডা আরো নতুন বাঁক নেয়। সেই বাঁকে দাঁড়িয়ে আছেন জহির রায়হান, দাঁড়িয়ে আছেন আলমগীর কবীর। তো কথায় কথায় একদিন হক ভাইকে বললাম, ‘এবার তো আপনার সেভেনটি নাইন হতে যাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘উনোআশি!’
হক বলেন, ‘ইংরেজিটাই তো ভালো শোনাল। সেভেনটি সেভেনটি মানে ধরো সত্তুরের সাউন্ডটা থাকে, উনো-আশি বললে আশি আশি লাগে। বেশি বয়স মনে হয়।’
হক ভাই হাসলেন। আমারও হাসি এসে যায় ঠোঁটে। বললাম, ‘বড় করে আপনার জন্মদিনটা হওয়া উচিৎ।’
‘কে করে আর!’

সৈয়দ হকের ৭৯ তম জন্মদিন পালন করেছিলাম আমরা। সাদ্দাম সিকদার, মোস্তফা মনন, পূজা সেনগুপ্ত, জয়িতা মহলানবীশ, গাজী রাকায়েত, শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা বিভাগ ও মেইন অডিটোরিয়ামের স্টাফরা এবং সর্বোপরি ডিজি লিয়াকত আলী লাকী, সবার দুর্দান্ত সাপোর্টে অনুষ্ঠিত হলো সৈয়দ হকের ৭৯তম জন্মদিন। শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, নাট্য নির্দেশক আতাউর রহমান, নির্দেশক-অভিনেতা মামুনুর রশীদ, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, রাজনীতিবিদ নূহ-উল আলম লেনিন, বাংলা একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খান, আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং সৈয়দ হক মঞ্চে ছিলেন। হক কবিতা পড়েছিলেন সেদিন প্রায় ৫০ মিনিট, দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে, দুহাত নাড়িয়ে। আনন্দিত কিশোর সেদিন সৈয়দ হক। আমরা যদি সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও করতে পারতাম! আফসোস থেকেই যাচ্ছে, এই গরিবি-অর্থনৈতিক জীবনে! সেদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ডিজি লাকী ভাই হক-জন্মজয়ন্তি পালনে দিলেন প্রধান অডিটোরিয়াম। একটি প্রকাশনা করেছিলাম, ‘সামান্য কিছু’ ‘আ লিটল বিট’ ‘সৈয়দ হক স্মারক সংখ্যা’- যাতে সাদ্দাম হোসেন ওরফে সিকদারেরই চৌদ্দ আনা কৃতিত্ব। হক ভায়ের কয়েকশত ফটোগ্রাফি করিয়েছিলাম। পুরো ব্যাপারটি হক ভাইকে খুব প্রাণবন্ত করেছিল। শিল্পকলার প্রধান অডিটোরিয়াম মঞ্চের ব্যাকড্রপে রেখেছিলাম ১৬ ফুট বাই ৬ ফুটের হ্যাঙ করা হকের পোর্ট্রেট, আর তার স্বাক্ষর। জন্মদিনে নিজের মুখোমুখি সৈয়দ শামসুল হক। 
৭৫০ সিটের অডিটোরিয়াম। দর্শক পূর্ণ হয়েও আরো কিছু দাঁড়িয়ে আছে। আড়াই ঘণ্টার একটি জন্মদিন পালন অনুষ্ঠান। যেভাবে বলেছি, হক ভাই টাইমিং রক্ষা করে তা শেষ করলেন। 
‘অন্ধকার মঞ্চ। স্পট লাইট ডায়াসের ওপর পড়বে। উপস্থাপককে দেখা যাবে। কবি আফরোজা সোমা উপস্থাপক। সোমার কিছু কথার পর মঞ্চ ফের অন্ধকার। বাজবে বাঁশি। মিনিট দেড়েকের বাঁশির পর মিডল স্টেজে আস্তে আস্তে লাইট আপ হবে এবং সেই লাইটে দেখা যাবে, সৈয়দ হক নিজেকে দেখছেন এবং লাইট পুরো মঞ্চ কভার করার পর হক ঘুরে তাকাবেন হলভর্তি দর্শকের দিকে, দর্শকের উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ছুড়ে দেবেন ডান হাতের আঙুল ঠোঁটে তুলে।’ 
হক ভালোবাসা জানালেন। হককেও ভালোবাসি আমরা, তার বর্ণাঢ্য সৃষ্টিকর্মের নিরিখে। তিনি সফল চাষা, বাংলাভাষার।

কদিন পরই, হক ভাই ফোনে বললেন, ‘বারিধারায় একটি বাড়িতে আমার বার্থ ডে করবে তারা, আসতে পারবে?’ সেদিন গেলাম বারিধারায়। এলিট এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি। খান মূলত ব্যবসায়ী। চিত্রকলার উঁচুদরের কারবারি। তার বাড়িতেই হকের বার্থ ডে উৎসব। সোমা আর আমি গেছি উৎসবে। দেশের চিত্রকরদের একটা অংশ ছিল সে অনুষ্ঠানে। মদ্যপান ছিল। রাশান অ্যাম্বেসির প্রটোকল অফিসার এক জর্জীয় সুন্দরী, দক্ষিণ কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত হককে বললেন, ‘ইউ আরো সেভেনটি নাইন? হাউ কাম? ইউ আর লুকিং ফিফটি নাইন অনলি!’
হকের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে কবিতা পড়ছিলেন সৈয়দ হক। একাধিক। হঠাৎ হক স্পিকারে ডাকলেন, ‘হোয়ার ইজ আওয়ার ইয়াং পোয়েট টোকন ঠাকুর?’ 
বাড়ির ইনডোরেই বানানো মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সৈয়দ হকের ছবি দিয়ে ইংরেজিতে ব্যাকড্রপ প্রিন্ট করা। চারপাশে শুধু পেইনটিং। ড্রইং রুমে দেখলাম একটি কোর্তা। গ্লাস দিয়ে ঘেরা। ক্যাপশন পড়লাম, ‘নবাব সিরাজউদৌলার কোর্তা।’ এনায়েতউল্লাহ খান, আগেই বললাম না, তিনি কালেক্টর, ব্যবসায়ী। হক আবার ডাকলেন, ইংরেজিতেই। কারণ, ওখানে বিদেশী লোক ছিলেন ৫০ জনের মতো। দেশী ৬০ জন, যাদের বেশির ভাগই কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট। যাদের সবাই আমার পরিচিত, কারণ, আমরা আমরা জয়নুল আবেদিনের স্কুলের ছাত্র, চারুকলায় পড়েছি। তো, আমি গেলাম হক ভাইয়ের কাছে, যেখানে তিনি চেয়ারে বসে কবিতা পড়ছিলেন। কাছে যেতেই হক ভাই বললেন, ‘একা কতক্ষণ কবিতা পড়ব? তুমি বসো। কিছুক্ষণ চালাও।’
বললাম, ‘এখানে তো ইংরেজি কবিতা পড়তে হবে, আমার কবিতা তো ইংরেজি করা নেই। প্রস্তুতিও নেই আমার।’
হক ভাই আদেশ দিলেন মনে হলো, ‘বসো তো। কিছুক্ষণ মেমোরি থেকেই পড়ো।’
বলেই হক ভাই উঠে পড়লেন মানেই আমাকে সিটে বসতে হলো এবং আমি নিজের কবিতা নিয়ে কি বলব, হক ভাই সম্পর্কে আমার কিছু পার্সেপশন বলছিলাম।

রাজশাহীতে, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসির অনুষ্ঠান, বাংলা একাডেমি, বইমেলায় কত কতভাবে সৈয়দ হককে কত রকমভাবে দেখেছি, পেয়েছি। আর আড্ডা দিয়ে গেছি। মনে আছে, একদিন বললাম, ‘হক ভাই, আমি তো আপনার সঙ্গে আড্ডা দিই, সব্যসাচী হকের সঙ্গে। আপনি কার সঙ্গে আড্ডা দেন?’
‘একজন কবির সঙ্গে। শিল্পীর সঙ্গে। বন্ধুর সঙ্গে।’ 
হকের কথায় লাজুক হয়ে পড়েছি। হকের সঙ্গে আড্ডায় আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠেছি। হক ভাই হাসতে হাসতে কিশোর হয়ে পড়েছেন। তিনি চিরকালের চিরকিশোর। কী বর্ণাঢ্য তাঁর ব্যক্তিত্ব! তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে কেবল শেখারই ছিল আমার, যেমন তাঁর রচনায় রয়েছে শেখার অসীম উপাদান। শিখতে চেয়েছি, যতটা শিখতে তিনি সুযোগ দিয়েছেন, ততটা শিখতে পারিনি। তাঁকে ভালোবেসেছি, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর লেখাকেও ভালোবাসি। এই ভালোবাসাতেও কিছু শিখতে পারি। 

প্রিয় হক ভাই, আপনার সঙ্গে আড্ডাগুলো আর পাব না। এই অতৃপ্তি, এই শূন্যতা আমাকে মন খারাপ করে রেখেছে। কী করব?

জয় পরাজয় আরো খবর

adv
সর্বশেষ সংবাদ
সাক্ষাতকার
adv
সব জেলার খবর
মুক্তমত
আর্কাইভ
October 2016
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  


বিজ্ঞাপন দিন

adv

মিডিয়া